এ বছরের আলোচিত আগুনের ঘটনা

বছরের আলোচিত আগুনের ঘটনা

সিটিজিট্রিবিউন: প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তিতে বছরজুড়ে ছিলো নানান আলোচনা-সমালোচনা। তবে, বছরের বেশিরভাগ সময়ই আলোচনায় ছিলো ‘আগুন’বছর বেশ কয়েকবার আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। সবচেয়ে বড় আগুনের ঘটনা ঘটে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী একটি লঞ্চে।

আগুনের ঘটনা কেন বাড়ছে-বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগুনের ঘটনা এভাবে বাড়ার পরও জনসচেতনতা বাড়েনি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেমন-ফায়ার সার্ভিস, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন এবং আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবনসহ কল-কারখানাগুলোতে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিতে সঠিক নজরদারি করতে পারছে না বা করছে না। আর এ কারণে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েই চলছে।

এছাড়া অতি লাভের আশায় মালিকপক্ষের অবহেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লাগা আগুনে শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে উল্লেখ করে তারা বলছেন, আগুনের ঘটনায় নানামুখী চাপে দু-একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও বিচারের মাধ্যমে অভিযুক্তদের সাজার কোনো নজির নেই।

উপযুক্ত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের সাজার নজির সৃষ্টি করতে হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বছরের কিছু আলোচিতে আগুনের ঘটনার চিত্র তুলে ধরা হলো-

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন এ বছরের প্রথম আলোচিত আগুনের ঘটনা ঘটে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। গত ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ৯ নম্বর বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে ১০ জনের মৃত্যু হয় এবং আহত হন প্রায় শতাধিক মানুষ। এছাড়া আগুনে ক্যাম্পের ১০ হাজারের অধিক ঝুপড়ি ঘর ও দোকান পুড়ে যায়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও)-এর অফিস, হাসপাতাল ও শিক্ষাকেন্দ্র পুড়ে যায়।

পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আগুন

রাজধানীর পুরান ঢাকার আরমানিটোলার হাজি মুসা ম্যানশনে কেমিক্যাল গোডাউনে গত ২২ এপ্রিল দিবাগত রাত ৩টার দিকে আগুন লাগে। এ ঘটনায় ৪ জন মারা যান এবং দগ্ধ হয়েছিলেন প্রায় ২৫ জন।

ঢাকার মগবাজারে বিস্ফোরণ

রাজধানীর মগবাজারের ওয়ারলেস গেইট এলাকায় গত ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যু হয় এবং দগ্ধ হন প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ। বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে-এর বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। ভবনটির নিচতলার দেওয়ালগুলো ধসে পড়ে এবং দোকানের সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। বিস্ফোরণে আশপাশের কয়েকটি ভবন প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এতে বেশ কয়েকটি ভবনের জানালার কাচ ভেঙে যায়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় একাধিক পরিবহন।

নারায়ণগঞ্জের সেজান জুস কারখানায় আগুন

নারায়ণগঞ্জ রুপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়নের কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান কারখানায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। গত ৮ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৪৮ জনের লাশ পুড়ে কঙ্কাল হয়ে যায়। পরে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় শনাক্ত করে দু’দফায় ৪৫ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকী তিনজনের লাশ এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জানা যায়, কারখানার নিচ তলার সেন্ট্রাল রুমে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে বিভিন্ন ফ্লোরে তা ছড়িয়ে পড়ে।

দুর্ঘটনার পর রুপগঞ্জ থানা পুলিশ একটি হত্যা মামলা করে। ওই মামলায় হাসেম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তার ৪ ছেলে এবং ৩ কর্মকর্তাসহ মোট ৮জনকে গ্রেফতার হয়। এদের ৪ দিন রিমান্ড শেষে হাসেমের দুই সন্তানের জামিন এবং ৬ জনকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। পরে জেল থেকে ছাড়া পায় আবুল হাসেম ও তার দুই ছেলে। এখনো জেলে রয়েছেন হাসেম গ্রুপের তিন কর্মকর্তা।

পুরান ঢাকার জুতার কারখানায় আগুন

রাজধানীর পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটে একটি জুতার কারখানায় গত ৫ নভেম্বর রাত ১টার দিকে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে ৫ জন শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় আহত হন আরও প্রায় ২০ জন।

বগুড়ায় প্লাস্টিক কারখানায় আগুন

বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহারের হবির মোড়ে বিআইআরএস নামে একটি প্লাস্টিক কারখানায় গত ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে ৫ জনের মৃত্যু হয়।

তেলবাহী জাহাজে আগুন

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অবস্থানকারী তেলবাহী জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। গত ১২ নভেম্বর সকাল সোয়া ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে একজন মারা যান। এ ঘটনায় আহত ৫ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে আগুন

বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী একটি লঞ্চে। এ বছরের সর্বশেষ মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনা এটি। গত ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগে। এতে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়।

লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের ক্যান্টিনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে আগুন ধরে যায় ১৩ ব্যারেল ডিজেলে। যা ছড়িয়ে পড়ে পুরো লঞ্চে। এ ঘটনায় ঘটনায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। আহতরা ঝালকাঠি, বরিশাল ও ঢাকা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও ম্যানটেনেন্স) লেফটেনেন্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ঘটনা তদন্তে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। পুরো তদন্ত শেষ করতে আমাদের প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। এরপর আমরা একটা ধারণা দিতে পারবো-কোন কারণে আগুন লেগেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগুনের ঘটনা এমন একটা দুর্ঘটনা, যাতে ক্রাইমসিন আলামতগুলোও নষ্ট করে দেয়। তবে মনে হয়েছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অসাবধানতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এতো পরিমাণে হতাহত হয়েছে। আগুন লাগার পরে নির্বাপণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লাইফ জ্যাকেট ও বয়া পর্যাপ্ত না থাকলেও যা ছিল তা ব্যবহারে সরবরাহ করা হয়নি। যখন আগুন লেগেছে এরপরও এক ঘণ্টার বেশি সময় লঞ্চ চালিয়েছে। শুরুতেই যদি কোনো তীরে ভিড়ানো হতো তাহলে ক্ষয়ক্ষতি এতো বেশি হতো না। জানমাল রক্ষা পেতো।’

উল্লেখ্য, দেশের বড় আগুনের ঘটনার পাশাপাশি নারায়নগঞ্জে আগুনের ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে ব্যাপক আগুনের ঘটনা ঘটে। কোন প্রাণহানি না হলেও আগুনের পুড়ে নষ্ট হয়েছে মূল্যবান সম্পদ।

নারায়ণগঞ্জ জেলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সূত্রমতে, ২০২১ সালের প্রথম সাত মাসে জেলাজুড়ে ৪১০টি আগুনের ঘটনা ঘটে। এসব আগুনের  ঘটনায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ৩৩ কোটি ৪০ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা। গত বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ৫৯৪টিম প্রতিবেদন:কেইউকে প্রতিবেদন:কেইউকে।

Leave a Reply