সিটিজি ট্রিবিউন ডটকম ০৬:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
চবি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী সমিতির অভিষেক রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ হয়, আগুনসন্ত্রাসীদের সাথে নয় : তথ্যমন্ত্রী সিটিজিট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক আয়াজ আহমেদ সানি’র মায়ের মৃত্যু অসুস্থ মায়ের জন্য দোয়া চাইলেন : সাংবাদিক আয়াজ আহমদ সানি অনিয়মের অভিযোগে লক্ষ্মীপুর-৩ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনের ফলাফলের গেজেট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন বান্দরবান জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের আত্ন-প্রকাশ আগামীকাল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আন্তজার্তিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের যৌক্তিকতা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন ঢাকার বাড্ডায় ‘সেলুন পাঠাগার বিশ্বজুড়ে’র বুক সেলফ বিতরণ মা হওয়ার ইচ্ছা ছিল অঙ্কিতার, ‘বিগ বস’-এ ভিকির সঙ্গে অশান্তির পরে কি ভেস্তে যাবে সব? দূর্গাপূজা উপলক্ষে র‍্যাবের রোবাস্ট পেট্রোলিং ও চেকপোস্ট
রাজনীতির সকল সংবাদ ::

সমাজ সেবায় জনাব গোলাম কীবরিয়া;এ এ কে আরেফউদ্দীন(ফাহিম)

  • Ashiq Arfin
  • আপডেট সময় : ০৮:০৯:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ জুলাই ২০২৩
  • ৬৯৭ বার পড়া হয়েছে

কলাম:সমাজ সেবায় জনাব গোলাম কীবরিয়া

সমাজ সেবা বলতে আমরা অনেকেই শুধু বুঝি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সমাজ সেবা বলতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় তিনটি উন্নয়নের সমন্বয়কে বুঝায়। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসে, যারা প্রচার বিমুখতায় সমাজের উন্নয়নে কাজ করে যান, যারা সমাজ উন্নয়নে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ধর্মীয় উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়ন করে থাকেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মরহুম আলহাজ গোলাম কীবরিয়া। যিনি তার চাকুরী থাকাকালীন সময়ে এবং চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা ও ধর্মীয় উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর চাকুরীকালীন ও অবসরকালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নয়ন সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো।
চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নঃ
চট্টগ্রাম বন্দর, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই বন্দর আজকের এই জায়গায় আসার পিছনে যে ব্যক্তিটির নীরব ভূমিকা ও যিনি নীরবে বীজ রোপন করেছেন তিনি হলেন জনাব গোলাম কীবরিয়া, স্বাধীন বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রথম চেয়ারম্যান। যিনি ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৮ সালে জানুয়ারীতে অবসরে যান।
জনাব গোলাম কীবরিয়া, ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে রেলওয়ে থেকে যোগদান করেন, তার আগে রেলওয়ে এবং বন্দর একসাথে ছিল। বন্দরের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তিনি প্রথম বাঙালী হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্রাফিক ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হোন যদিও সে সময়ে বন্দরের একটি পক্ষ চায়নি তিনি অথবা অন্যকোন বাঙালি যাতে ট্রাফিক ম্যানেজার হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে তার করা কিছু কাজ যা চট্টগ্রাম বন্দরকে আজকের এই পর্যায়ে আসতে সাহায্য করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো।
১. বন্দর চ্যানেল থেকে রাশিয়া দলের সহায়তায় মাইন অপসারণঃ এটি একটি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ। এটির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে এখনও জাহাজ ঢুকতে পারে। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানকে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বুঝাতে সক্ষম হোন যে বন্দর চ্যানেল থেকে যুদ্ধের সময় যে মাইন দেওয়া হয়েছিল সেগুলো যদি অপসারণ করা না হয় তাহলে সময়ের সাথে বন্দর চ্যানেল অচল হয়ে পড়বে এবং দেশের অর্থনীতি ও মুখ থুবড়ে পড়বে কেননা স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে এখনও পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অন্যতম প্রধান সমুদ্র বন্দর । এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাশিয়া সফরে রাশিয়া সরকারকে অনুরোধ করলে রাশিয়া সরকারের সহযোগিতায় ও তাঁর (জনাব কীবরিয়া) নেতৃত্বে বন্দর চ্যানেল থেকে মাইনগুলো অপসারণ করা হয় যদিও রাশিয়ার দলটি চেয়েছিল শুধুমাত্র মাইনগুলোর মাথাগুলো কেটে দিতে কিন্তু তিনি রাজী হননি বরং মাইনগুলো পুরোপুরি অপসারণ করতে বাধ্য করেছেন রাশিয়ার মাইন অপসারণ দলকে কেননা তিনি জানতেন মাইনগুলো পুরোপুরি অপসারণ না করলে পরবর্তী সময়ে বন্দর চ্যানলের নাব্যতা কমে যাবে এবং বন্দরে জাহাজ ঢুকতে পারবে না সাথে জাহাজ দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও থাকবে।
২. জেটি পুনঃনির্মাণঃ তাঁর অন্যতম একটি উদ্যোগ হল যুদ্ধ বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলো পুনঃ নির্মাণ। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বন্দরের উন্নতি এবং সেবা প্রদানের জন্য যুদ্ধের সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া জেটিগুলো পুনঃ নির্মাণ করতে হবে নয়তো বন্দর দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে না এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিত্যক্ত বন্দরে পরিণত হবে।
.প্রথম কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং– চট্টগ্রাম বন্দরকে আধুনিক বন্দরে রূপান্তরের তার অন্যতম একটি উদ্যোগ হল কন্টেইনার পণ্য হ্যান্ডেলিং করার উদ্যাগ গ্রহণ করা। বর্তমানে পণ্য পরিবহণের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হল কন্টেইনার। ১৯৭০ এর দশকে উন্নত দেশে অনেক শিপিং কোম্পানী কন্টেইনার করে পণ্য পরিবহণ করতো সীমিত পরিসরে কেননা তখন কন্টেইনারে করে পণ্য পরিবহণ এতটা জনপ্রিয় ও ছিলনা এবং কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং এর আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ছিলনা। তখন বাল্ক জাহাজ হ্যান্ডেলিং এর যন্ত্রপাতি দিয়ে সীমিত পরিসরে বিশ্বের অনেক দেশ কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করতো। তিনি বন্দরের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তিনি এবং তার দল ১৯৭৪ সালের দিকে তৎকালীন যন্ত্রপাতি দিয়ে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করে চট্টগ্রাম বন্দরকে নতুন এক মাত্রায় নিয়ে যান এবং প্রমাণ করেন যে চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিক বিশ্বর অন্যান্য বন্দরের ন্যায় সব ধরণের পণ্য হ্যান্ডেলিং করতে সক্ষম।
৪. বন্দর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাঃ স্বাধীনতার পরে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিলনা বিধায় চিকিৎসার জন্য তখন বন্দরে চাকুরীরত মানুষজনকে বা পরিবারের সদস্যদেরকে কষ্ট করে চট্টগ্রাম হাসপাতাল বা রেলওয়ে হাসপাতালে আসতে হতো। আবার অনেক কর্মচারী বা তাদের পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা সেবার খরচ বহণ করা কষ্টসাধ্য বা ব্যয়বহুল ছিল যার ফলশ্রুতিতে তিনি বন্দরের নিজস্ব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং ১৯৭৬ সালে বন্দর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন বন্দরের চাকরীরত কর্মকতা ও তাদের পরিবারের চিকিৎসা সুবিধার জন্য।
৫. পোর্ট ট্রাস্ট থেকে পোর্ট অথরিটি করার মাধ্যমে বন্দরের নিজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থাপনা করাঃ চট্টগ্রাম বন্দরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার তার একটি অন্যতম উদ্যোগ। স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালিত হতো ট্রাস্টের মাধ্যমে এবং সেই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নাম ছিল “চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্ট” । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এবং তৎকালীন সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হোন যে, বন্দরের কাজের গতিশীলতা ও বন্দরের উন্নয়নের জন্য এটি ট্রাস্টের মাধ্যমে নয় বরং পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে পরিচালিত করলে বন্দর ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই লাভবান হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের “চিটাগাং পোর্ট অথরিটি বা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ” নামকরণ এবং বন্দর এখন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলছে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

৬. জেটি সম্প্রসারণ, সিএফএস স্থাপনার প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাবনাঃ তিনি তার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশের বন্দর ঘুরার সুবিধার্থে বুঝতে পেরেছিলেন দেশের ও বন্দরের উন্নয়ন্নের জন্য এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের উন্নত সেবা প্রদান করার জন্য বন্দরের জেটি সম্প্রসারণ, বড় জেটি নির্মাণ (আজকের সিসিটি ও এনসিটি যদিও তিনি নামগুলো নির্ধারণ করেননি) ও কার্গো ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস) স্থাপন করা অত্যাবশক নয়তো আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সেবা ও সুবিধার দিক দিয়ে পিছিয়ে পরবে এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয়তা হারাবে।
৭. চট্টগ্রাম ও মংলা (চালনা) বন্দরের পরামর্শকঃ চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বন্দর উন্নয়ন তথা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য বন্দরের পরামর্শক হিসেবে কাজ করার জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে কেএস এম এসোসিয়েট (পরামর্শক প্রতিষ্ঠান) গঠন করেন চট্টগ্রাম ও মংলা (চালনা) বন্দরের পরামর্শক হিসেবে বন্দরের উন্নয়নে কাজ করেন।

বায়তুশ শরফ
১. সাধারণ সম্পাদক আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশঃ এটি তাঁর জীবনের অন্যতম কাজ, যেটির মাধ্যমে তিনি দ্বীনি সেবা ও সমাজসেবা দুইটি প্রত্যক্ষভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন। আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশের তৎকালীন সভাপতি ও বায়তুশ শরফের সম্মানিত হুজুর কেবলা জনাব আলহাজ আব্দুল জব্বার (রহঃ), ১৯৮৬ সালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একটানা ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৬ সালে বার্ধক্য জনিত কারণে তৎকালীন সভাপতি ও বায়তুশ শরফের সম্মানিত হুজুর কেবলা বাহ্রুল উলুম জনাব আলহাজ মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ( রহঃ) এর ইজাজতে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন যদিও তারপরও দরবারের প্রয়োজনে তিনি সাহায্য করার চেষ্টা করেছন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, বিভিন্ন কর্ম এলাকায় সংগঠনের কাজ প্রসারণ ও সুষ্ঠভাবে সম্পাদন করা সহ যাবতীয় কাজ নিষ্ঠা ও সফলতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছেন।
২. প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেন্সিপ্যাল বায়তুশ শরফ মাদ্রাসাঃ চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের অন্যতম অরাজনৈতিক, সমাজসেবী ও দ্বীনিই দরবার বায়তুশ শরফের সাথে সম্পৃক্ত হোন এবং তৎকালীন পীর সাহেব ও প্রতিষ্ঠাতা প্রেন্সিপ্যাল জনাব আলহাজ আব্দুল জব্বার (রহঃ) ওনাকে ভাইস প্রেন্সিপ্যাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য অনুরোধ করলে তিনি ১৯৭৮ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন, পীর সাহেব কেবলার নির্দেশক্রমে। উক্ত সময়ে তিনি প্রেন্সিপ্যাল ও অনান্যদের সহযোগিতায় মাদ্রাসার একটি ভিক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন যাতে এতিম অসহায় ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হতে পারে।

আর তাইতো “মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়ে” আর সেটিই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন জনাব গোলাম কীবরিয়া।

লেখকঃ এ এ কে আরেফউদ্দীন(ফাহিম)
সদস্য, আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ
উন্নয়নকর্মী, কর আইনজীবি ও মেরিটাইম প্রফেশনাল
সম্পাদনা:আর

সোস্যাল মিডিয়া শেয়ার করুন
জনপ্রিয় সংবাদ

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থানার অস্ত্র মামলায় আসামি গ্রেফতার।

আরবাজের সঙ্গে প্রেম ভেঙেছে বিদেশিনীর, দায়ী কি মালাইকা! মুখ খুললেন জর্জিয়া

সমাজ সেবায় জনাব গোলাম কীবরিয়া;এ এ কে আরেফউদ্দীন(ফাহিম)

আপডেট সময় : ০৮:০৯:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ জুলাই ২০২৩

কলাম:সমাজ সেবায় জনাব গোলাম কীবরিয়া

সমাজ সেবা বলতে আমরা অনেকেই শুধু বুঝি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সমাজ সেবা বলতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় তিনটি উন্নয়নের সমন্বয়কে বুঝায়। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসে, যারা প্রচার বিমুখতায় সমাজের উন্নয়নে কাজ করে যান, যারা সমাজ উন্নয়নে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ধর্মীয় উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়ন করে থাকেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মরহুম আলহাজ গোলাম কীবরিয়া। যিনি তার চাকুরী থাকাকালীন সময়ে এবং চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা ও ধর্মীয় উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর চাকুরীকালীন ও অবসরকালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নয়ন সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো।
চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নঃ
চট্টগ্রাম বন্দর, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই বন্দর আজকের এই জায়গায় আসার পিছনে যে ব্যক্তিটির নীরব ভূমিকা ও যিনি নীরবে বীজ রোপন করেছেন তিনি হলেন জনাব গোলাম কীবরিয়া, স্বাধীন বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রথম চেয়ারম্যান। যিনি ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৮ সালে জানুয়ারীতে অবসরে যান।
জনাব গোলাম কীবরিয়া, ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে রেলওয়ে থেকে যোগদান করেন, তার আগে রেলওয়ে এবং বন্দর একসাথে ছিল। বন্দরের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তিনি প্রথম বাঙালী হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্রাফিক ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হোন যদিও সে সময়ে বন্দরের একটি পক্ষ চায়নি তিনি অথবা অন্যকোন বাঙালি যাতে ট্রাফিক ম্যানেজার হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে তার করা কিছু কাজ যা চট্টগ্রাম বন্দরকে আজকের এই পর্যায়ে আসতে সাহায্য করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো।
১. বন্দর চ্যানেল থেকে রাশিয়া দলের সহায়তায় মাইন অপসারণঃ এটি একটি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ। এটির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে এখনও জাহাজ ঢুকতে পারে। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানকে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বুঝাতে সক্ষম হোন যে বন্দর চ্যানেল থেকে যুদ্ধের সময় যে মাইন দেওয়া হয়েছিল সেগুলো যদি অপসারণ করা না হয় তাহলে সময়ের সাথে বন্দর চ্যানেল অচল হয়ে পড়বে এবং দেশের অর্থনীতি ও মুখ থুবড়ে পড়বে কেননা স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে এখনও পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অন্যতম প্রধান সমুদ্র বন্দর । এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাশিয়া সফরে রাশিয়া সরকারকে অনুরোধ করলে রাশিয়া সরকারের সহযোগিতায় ও তাঁর (জনাব কীবরিয়া) নেতৃত্বে বন্দর চ্যানেল থেকে মাইনগুলো অপসারণ করা হয় যদিও রাশিয়ার দলটি চেয়েছিল শুধুমাত্র মাইনগুলোর মাথাগুলো কেটে দিতে কিন্তু তিনি রাজী হননি বরং মাইনগুলো পুরোপুরি অপসারণ করতে বাধ্য করেছেন রাশিয়ার মাইন অপসারণ দলকে কেননা তিনি জানতেন মাইনগুলো পুরোপুরি অপসারণ না করলে পরবর্তী সময়ে বন্দর চ্যানলের নাব্যতা কমে যাবে এবং বন্দরে জাহাজ ঢুকতে পারবে না সাথে জাহাজ দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও থাকবে।
২. জেটি পুনঃনির্মাণঃ তাঁর অন্যতম একটি উদ্যোগ হল যুদ্ধ বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলো পুনঃ নির্মাণ। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বন্দরের উন্নতি এবং সেবা প্রদানের জন্য যুদ্ধের সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া জেটিগুলো পুনঃ নির্মাণ করতে হবে নয়তো বন্দর দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে না এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিত্যক্ত বন্দরে পরিণত হবে।
.প্রথম কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং– চট্টগ্রাম বন্দরকে আধুনিক বন্দরে রূপান্তরের তার অন্যতম একটি উদ্যোগ হল কন্টেইনার পণ্য হ্যান্ডেলিং করার উদ্যাগ গ্রহণ করা। বর্তমানে পণ্য পরিবহণের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হল কন্টেইনার। ১৯৭০ এর দশকে উন্নত দেশে অনেক শিপিং কোম্পানী কন্টেইনার করে পণ্য পরিবহণ করতো সীমিত পরিসরে কেননা তখন কন্টেইনারে করে পণ্য পরিবহণ এতটা জনপ্রিয় ও ছিলনা এবং কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং এর আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ছিলনা। তখন বাল্ক জাহাজ হ্যান্ডেলিং এর যন্ত্রপাতি দিয়ে সীমিত পরিসরে বিশ্বের অনেক দেশ কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করতো। তিনি বন্দরের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তিনি এবং তার দল ১৯৭৪ সালের দিকে তৎকালীন যন্ত্রপাতি দিয়ে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করে চট্টগ্রাম বন্দরকে নতুন এক মাত্রায় নিয়ে যান এবং প্রমাণ করেন যে চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিক বিশ্বর অন্যান্য বন্দরের ন্যায় সব ধরণের পণ্য হ্যান্ডেলিং করতে সক্ষম।
৪. বন্দর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাঃ স্বাধীনতার পরে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিলনা বিধায় চিকিৎসার জন্য তখন বন্দরে চাকুরীরত মানুষজনকে বা পরিবারের সদস্যদেরকে কষ্ট করে চট্টগ্রাম হাসপাতাল বা রেলওয়ে হাসপাতালে আসতে হতো। আবার অনেক কর্মচারী বা তাদের পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা সেবার খরচ বহণ করা কষ্টসাধ্য বা ব্যয়বহুল ছিল যার ফলশ্রুতিতে তিনি বন্দরের নিজস্ব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং ১৯৭৬ সালে বন্দর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন বন্দরের চাকরীরত কর্মকতা ও তাদের পরিবারের চিকিৎসা সুবিধার জন্য।
৫. পোর্ট ট্রাস্ট থেকে পোর্ট অথরিটি করার মাধ্যমে বন্দরের নিজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থাপনা করাঃ চট্টগ্রাম বন্দরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার তার একটি অন্যতম উদ্যোগ। স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালিত হতো ট্রাস্টের মাধ্যমে এবং সেই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নাম ছিল “চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্ট” । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এবং তৎকালীন সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হোন যে, বন্দরের কাজের গতিশীলতা ও বন্দরের উন্নয়নের জন্য এটি ট্রাস্টের মাধ্যমে নয় বরং পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে পরিচালিত করলে বন্দর ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই লাভবান হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের “চিটাগাং পোর্ট অথরিটি বা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ” নামকরণ এবং বন্দর এখন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলছে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

৬. জেটি সম্প্রসারণ, সিএফএস স্থাপনার প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাবনাঃ তিনি তার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশের বন্দর ঘুরার সুবিধার্থে বুঝতে পেরেছিলেন দেশের ও বন্দরের উন্নয়ন্নের জন্য এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের উন্নত সেবা প্রদান করার জন্য বন্দরের জেটি সম্প্রসারণ, বড় জেটি নির্মাণ (আজকের সিসিটি ও এনসিটি যদিও তিনি নামগুলো নির্ধারণ করেননি) ও কার্গো ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস) স্থাপন করা অত্যাবশক নয়তো আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সেবা ও সুবিধার দিক দিয়ে পিছিয়ে পরবে এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয়তা হারাবে।
৭. চট্টগ্রাম ও মংলা (চালনা) বন্দরের পরামর্শকঃ চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বন্দর উন্নয়ন তথা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য বন্দরের পরামর্শক হিসেবে কাজ করার জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে কেএস এম এসোসিয়েট (পরামর্শক প্রতিষ্ঠান) গঠন করেন চট্টগ্রাম ও মংলা (চালনা) বন্দরের পরামর্শক হিসেবে বন্দরের উন্নয়নে কাজ করেন।

বায়তুশ শরফ
১. সাধারণ সম্পাদক আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশঃ এটি তাঁর জীবনের অন্যতম কাজ, যেটির মাধ্যমে তিনি দ্বীনি সেবা ও সমাজসেবা দুইটি প্রত্যক্ষভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন। আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশের তৎকালীন সভাপতি ও বায়তুশ শরফের সম্মানিত হুজুর কেবলা জনাব আলহাজ আব্দুল জব্বার (রহঃ), ১৯৮৬ সালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একটানা ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৬ সালে বার্ধক্য জনিত কারণে তৎকালীন সভাপতি ও বায়তুশ শরফের সম্মানিত হুজুর কেবলা বাহ্রুল উলুম জনাব আলহাজ মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ( রহঃ) এর ইজাজতে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন যদিও তারপরও দরবারের প্রয়োজনে তিনি সাহায্য করার চেষ্টা করেছন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, বিভিন্ন কর্ম এলাকায় সংগঠনের কাজ প্রসারণ ও সুষ্ঠভাবে সম্পাদন করা সহ যাবতীয় কাজ নিষ্ঠা ও সফলতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছেন।
২. প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেন্সিপ্যাল বায়তুশ শরফ মাদ্রাসাঃ চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের অন্যতম অরাজনৈতিক, সমাজসেবী ও দ্বীনিই দরবার বায়তুশ শরফের সাথে সম্পৃক্ত হোন এবং তৎকালীন পীর সাহেব ও প্রতিষ্ঠাতা প্রেন্সিপ্যাল জনাব আলহাজ আব্দুল জব্বার (রহঃ) ওনাকে ভাইস প্রেন্সিপ্যাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য অনুরোধ করলে তিনি ১৯৭৮ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন, পীর সাহেব কেবলার নির্দেশক্রমে। উক্ত সময়ে তিনি প্রেন্সিপ্যাল ও অনান্যদের সহযোগিতায় মাদ্রাসার একটি ভিক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন যাতে এতিম অসহায় ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হতে পারে।

আর তাইতো “মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়ে” আর সেটিই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন জনাব গোলাম কীবরিয়া।

লেখকঃ এ এ কে আরেফউদ্দীন(ফাহিম)
সদস্য, আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ
উন্নয়নকর্মী, কর আইনজীবি ও মেরিটাইম প্রফেশনাল
সম্পাদনা:আর